Monday, December 5, 2022

রেডিও বেত্যান্ত



যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পেরে উঠতে পারেনি, উনিশ শতকের তোলপাড় করা বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার বস্তুটি। আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। একে আসতে হয়েছে বহু লড়াই করে। আর আজ টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। ১৯০০ সালে ব্রাজিলিয়ান ধর্মযাজক রবার্ট ল্যান্ডেন ডি মউরা মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিজের কন্ঠস্বরকে স্থানান্তরিত করেন বেতার পদ্ধতিতে।

Heinrich Rudolf. Hertz দ্বারা ১৮৮০ দশকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের খোঁজ পান। এই তরঙ্গের মাধ্যমে কোন ভয়েস স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। এটা বিজ্ঞানীদের ধারণা হলো। তাই এটা নিয়ে গবেষণা শুরু হল। 
Guglielmo Marconi সেই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যার দ্বারা এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে, দীর্ঘ দূরত্বের যোগাযোগের জন্য একটি সফল যন্ত্র তৈরি হয়। Guglielmo Marconi, হলো সেই ব্যক্তি যাকে রেডিও প্রযুক্তির প্রধান আবিষ্কারক হিসেবে বলা যায়। 

বিশ্বের সর্ব প্রথম radio station চালু হয়েছিল New York শহরে। ভারতে প্রথম বারের জন্য ১৯২০ সালে মুম্বাই শহর থেকে বেতার রেডিও সম্প্রচার শুরু করা হলো। বেতার! কথাটির অর্থ হল তার যুক্ত নয়। 

তখন বাচ্চা বয়স। মসজিদে যেতাম। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। মাওলানা, মুন্সীজিদের কাছ থেকে শুনতাম, ইসলামে রেডিও সোনা বারণ। বাড়িতে তখন একটি রেডিও ছিল। বাবা শুনতেন। বাবা সর্বদা রেডিও শুনতেন। এবং বাবা মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন না। এজন্য আমি একদিন রেগে গিয়ে! রেডিও কাছার দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলাম। বাবা ভীষণ ভাবে আমার উপর রেগে গিয়েছিলেন। মায়ের হস্তক্ষেপে আমি সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম। 

তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। বড় হতে হতে নিজের মধ্যে পরিবর্তন এলো। পড়াশোনা সাথে সাথে খেলাধুলা আর খেলাধুলার সাথে সাথে রেডিও আমার সাথী হয়ে দাঁড়ালো। আমি গণিত করতে করতেই তখন রেডিওর বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠানের গান শুনতাম। সময় সময়ে আকাশবানীর খবর শুনতাম। প্রতিদিন সকালে প্রাপ্ত ভিকি নামে একটি অনুষ্ঠান হতো! সেটা আজকের হয় কিনা জানিনা! সেটা শুনতাম। 

এভাবেই রেডিও আমার জীবনসঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। এই রেডিও কখনো কখনো খারাপ হয়ে যেত। সেটা আবার নিজেই রেডিওর পেছনের ঢাকনা খুলে! এদিক ওদিক খুচে খুচে নিজেই সারাতাম। টাকার অভাবের কারণে ব্যাটারি কিনতে পারতাম না। তখন পুরনো ব্যাটারি গুলোকে জড়ো করে, কয়েকটা পাত্রে রেখে, তার দিয়ে সিরিজ করে, লবণ জলে ডুবিয়ে সোলার পাওয়ার সিস্টেম করে রেডিও চালাতাম। রেডিও স্পিকার থেকে ভালো এবং সুন্দর আওয়াজ পাওয়ার জন্য, রেডিও থেকে স্পিকারকে খুলে! রুমের এক কোনে রাখা মাটির কলসির মুখের উপর, স্পিকারকে উল্টো করে বসিয়ে রাখতাম। যেখান থেকে সুন্দর আওয়াজ বের হতো। 

আমাদের সময় প্রায় সবার বাড়িতে রেডিও থাকতো বটে, তবে টেপ রেকর্ডার থাকতো না। সময়ের সাথে সাথে রেডিও নিজেকে পাল্টেছে। সুন্দর আওয়াজ এবং সুন্দর ভাবে পরিবেশনের জন্য! মার্কেটে এলো এফ. এম রেডিও। এফ. এম এর সাথে আবার মার্কেটে সে গেল টেপ রেকর্ডার। এই টেপ রেকর্ডার আগেও ছিল। কিন্তু সে ছিলো একা। এখন যেখানে রেডিও থাকবে সেখান এফ. এম থাকবে এবং টেপ রেকর্ডার ও থাকবে। টেপ রেকর্ডার এ অডিও ক্যাসেট চালানো যাবে। 

তো আমার ভীষণ ইচ্ছে হলো! একটা টেপ রেকর্ডারের সাথে যুক্ত রেডিও ও এফ. এম কেনার। আমি প্রথম হলদিয়াতে কাজে গিয়ে, যে বেতন পেয়েছিলাম! বাবার হাতে কিছু তুলে বাকি কিছুটা অংশ দিয়ে কাঙ্খিত টেপ রেকর্ডার কিনেছিলাম। সেখানে রেডিও ও এফএম এবং অডিও ক্যাসেট চালানোর ব্যবস্থা ছিল। 

তখনকার সময় বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় অনুষ্ঠান হলে, তার জন্য আলাদা করে অস্থায়ী ভাবে রেডিও স্টেশন বা রেডিও চ্যানেল বানানো হতো। সেখান থেকে সম্প্রচার করা হতো সংশ্লিষ্ট এলাকায়, সেই অনুষ্ঠানের সারা দিনের লাইভ টেলিকাস্ট। যা আপনি দেখতে পাবেন না, তবে সমস্তটা শুনতে পাবেন খুব সুন্দর ভাবে। যেমনটা আমাদের এখানে হলদিয়াতে হলদিয়া উৎসবের সম্প্রসারণ করা হতো। তার জন্য আলাদা একটি রেডিও চ্যানেল থেকে। 

সে সময় রেডিও একচুয়াল বাড়ির বাইরে বের করানো যেত না। বাড়িতেই রাখতে হতো। মানুষের বাড়িতে থাকার যে অভ্যাস সেটা দিন দিন কমে যাচ্ছিল। ফলে বাড়ির বাইরে কাটানোর প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেড়ে যায়। যার ফলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এফ. এম যুক্ত রেডিওর আঁকার ছোট হয়ে যায়। তাই মার্কেটে এল ছোট রেডিও। মার্কেটে তখন ছোট্ট ছোট্ট পকেট এফ. এম রেডিও বের হলো। যার ফলে সেই পকেট এফএম রেডিও নিয়ে মানুষ বিভিন্ন জায়গায়, পাড়ায়, মহল্লায়, বাজারে বের হতে পারতো। 

এর ফলে বাড়িতে পুরনো রেডিওটি ব্যবহার করা ধীরে ধীরে কমে গেল। এবং দীর্ঘদিন ইলেকট্রনিক্স জিনিস ব্যবহার না করার ফলে সেটা খারাপ হতে থাকলো। এফ. এম রেডিও মার্কেটে ছেয়ে যাওয়ার পর এসে গেল মোবাইল ফোন। সেই মোবাইলেও এফএম ব্যবহার করা যায়। তবে আজও এফএম আছে। আজও সেই রেডিও স্টেশন গুলি আছে। বিবিধ ভারতী, আকাশবাণী কলকাতা আজও বহু পুরনো বয়সি লোকেরা অনুষ্ঠান দেখে। আকাশবাণীর খবর শুনে।

তবে আজকের দিনে সকালে সূর্য ওঠার আগে! সেই ভোরের সময় বিছানা থেকে উঠলে, মুরগির ডাক, পাখিদের কোলাহল, মসজিদে আযানের সাথে সাথেই রেডিওর সেই সুন্দর আওয়াজ! যেটা ছিল সানাই এর ন্যায়! চারিদিকে বাড়ি বাড়িতে সেই মিষ্টি মধুর আওয়াজ আর শোনা যায় না।

✍️আইয়ুব খাঁন
১৫/১০/২২

No comments:

Post a Comment